বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ রচনা ২০ পয়েন্ট।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ রচনা ২০ পয়েন্ট-আমাদের প্রত্যেক বাংলাদেশী মানুষের জানা দরকার। বাংলাদেশ আজ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। কিন্তু এই স্বাধীনতা পেতে বাংলাদেশের মানুষকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে।

টানা নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করার পরে বাংলাদেশের মানুষ পায় তাদের কাঙ্খিত স্বাধীনতা। এই যুদ্ধ ছিল বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির সগ্রাম, বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিলো ৭ কোটি মানুষের অধিকার রক্ষার যুদ্ধ।

সেই যুদ্ধে রক্ত দিয়ে জীবন দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতা। ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে ও লাখো শহীদ এর রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১সালের ২৬ মার্চ উদিত হয় বাংলাদেশ স্বাধীনতার লাল সূর্য। এ দেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিকামী মানুষ হারিয়েছে অনেক কিছু।

সর্বস্ব হারিয়েও তারা অর্জন করেছিল স্বাধীন সার্বভৌম স্বপ্নের একটি বাংলাদেশ। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর ভারত ও পাকিস্তান নামে দুইটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তানের দুইটি অংশ ছিল যার নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। দুই রাষ্ট্রের মধ্যে যেমন ছিল দূরত্বের ফারাক, তেমনি অধিকারের দিক থেকেও ছিল দুই রাষ্ট্রের মধ্যে অনেক তফাৎ।

তৎকালীন পাকিস্তান তথা বর্তমানের বাংলাদেশের মানুষের উপর প্রথম থেকেই পাকিস্তানিরা অত্যাচার চালাতে থাকে। বাংলাদেশ থেকে পাচার হতে থাকে সম্পদ। পূর্ব বাংলায় দ্রব্যমূল্যের দাম নিয়ে শুরু হয় বৈষম্য। তাছাড়া বিভিন্ন অধিকার থেকেও তারা বঞ্চিত হতে থাকে। ফলে সারা দেশে এক বিরাট বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় যা পরবর্তিতে আন্দোলনে রূপ নেয়।

এখানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ রচনা ২০ পয়েন্ট উল্লেখিত করা আছে:

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ রচনা

বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম। পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করলে ছাত্ররা রাস্তায় নেমে আসে। এরপর পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিকসহ আরও নাম না জানা অনেকে শহীদ হয়েছিলেন।

ছাত্রদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রথম অধিকারের আঘাত আনে তারা ভাষার উপর। এরপর ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তারা আমাদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকার করে। এরপর ১৯৬৬ সালের ছয় দফা এবং ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সুবাদে বাঙালিরা বুঝতে পারে যুদ্ধ ছাড়া এদেশে বাঙালিরা তাদের অধিকার পাবে না। সেই মুহূর্ত থেকেই মানুষের অন্তরে ক্ষোভ জমতে থাকে এবং তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে।

স্বাধীনতার ডাক

১৯৬৯ সালের গনঅভূত্থানের পর থেকেই বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেন এদেশকে স্বাধীন করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এদেশের মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে হলে সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে হবে। তাই ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে লাখো জনতার উদ্দেশ্যে স্বাধীনতার ডাক দেন।

এই ভাষণ ৭ই মার্চের ঐতিহাসির ভাষণ নামে পরিচিত। এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু সাধারণ জনগণকে যা কিছু আছে তা নিয়েই যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার আদেশ দেন। সেই ভাষণই ছিল বাঙালির দেশ স্বাধীন করার মূল প্রেরণা। সেই ভাষণে ছিল যুদ্ধের সকল দিকনির্দেশনা। তিনি বলেন-

“রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব
এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”

২৫শে মার্চের কালরাত্রি

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণের পর জনগণের মধ্যে দেখা দেয় স্বাধিকার চেতনা। সকলে সংগ্রামী মনোভাব দেখাতে শুরু করে। তখন পাকিস্তানিরা বাঙালিকে দমাতে নতুন পরিকল্পনা করে। ক্ষমতা হস্তান্তরের আশ্বাস দিয়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ২৫শে মার্চ ঢাকা ত্যাগ করেন এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসে অস্ত্রধারী ট্যাঙ্ক ও গোলাবারুদ।

২৫ শে মার্চ রাতে ঘুমন্ত বাঙালির উপর পাকিস্তানি বাহিনী ঝাপিয়ে পড়ে। সেদিন এক রাতে ঢাকায় প্রায় ২০ হাজার মানুষকে নিরীহভাবে হত্যা করা হয়। অবস্থা বুঝতে পেরে ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দেন। সেই রাতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাকে সেখানেই বন্দি করে রাখা হয়।

সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ

২৫শে মার্চের সেই নরকীয় হত্যার পরই বাঙালি বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পূর্ণ মর্ম বুঝতে পারে। তাই ২৬ শে মার্চ থেকেই সকল বাঙালি যে যা পারে তাই নিয়েই যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। তাদের মধ্যে বাংলাদেশ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাহসী সৈনিকরা সর্বপ্রথম সর্বপ্রথম ঝাপিয়ে পড়ে।

এ ছাড়া বাঙালী পুলিশ, ইপিআর ও আনসার আর্মিও একই সময়ে লড়াইয়ে অংশ নেয়। অনেক সাহসী তরুণ বাঙালি দেশে-বিদেশে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে থাকে। তাদের সাথে যোগ দেয় স্কুল কলেজের ছাত্র ও দিনমজুর, কৃষক ও শ্রমিকেরা।

মুক্তিবাহিনী ও মুক্তিযুদ্ধ

১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর জেনারেল এম.এ.জি. ওসমানীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমে এর সংখ্যা ছিল ১৩০০০ তারপরে দলে দলে বাংলার সাহসী তরুণরা অংশগ্রহণ করতে থাকে। জেনারেল এম.এ.জি. ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার চিফ ইন চার্জ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।

তার নেতৃত্বে গঠন করা হয় নিয়মিত বাহিনী ও অনিয়মিত গেরিলা বাহিনী। নিয়মিত বাহিনীর অধীনে সারা দেশে তিনটি ব্রিগেড ফোর্স গঠন করা হয় যা কে ফোর্স, জেড ফোর্স ও এস ফোর্স নামে পরিচিত।

তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধকে পরিচালনা করার জন্য দেশেকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। নিয়মিত সৈন্যরা মে মাস পর্যন্ত সফলভাবে যুদ্ধ করে। জুন মাসে, অনিয়মিত গেরিলা দল সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১০ নং সেক্টরের অধীনে থাকা মেরিন কমান্ডো বাহিনীও অত্যন্ত বীরত্ব ও কৃতিত্বের সাথে যুদ্ধ করে।

মুজিবনগর সরকার গঠন

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য একটি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠণ করা হয় যা মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত হয়। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথ ইউনিয়নের আমবাগানে এই সরকার শপথ গ্রহণ করেন।

এই দিন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাপত্র অনুযায়ী সেই সরকার কাজ করতে থাকে। পরবর্তীতে মেহেরপুর জেলার ঐ জায়গাটিকে মুজিবনগর নামে নামকরণ করা হয়।

মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা

মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। মুজিবনগর সরকারের প্রধান কাজই ছিল বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করা। মুজিবনগর সরকার দেশে ও দেশের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলে।

মুজিবনগর সরকার মুক্তিবাহিনীর সকল মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে তাদেরকে যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। তাছাড়া যুদ্ধকালীন মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ ও বিদেশের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে এই সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

মুক্তিযুদ্ধের মতো বিরূপ পরিস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মবিশ্বাস ও মনোবল বজায় রাখা ছিল অনেক বড় চ্যালেঞ্জ যা এই সরকার খুব ভালোভাবে পূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ জনগণ ও পেশাজীবীদের ভূমিকা

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান শক্তি ছিল বাংলার সাধারণ জনগণ। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে তারা একযোগে ঝাপিয়ে পড়ে মুক্তির সংগ্রামে। দেশের ছাত্র জনতা, পুলিশ, ইপিআর, কৃষক, শ্রমিক, পেশাজীবী সকলেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল।

যুদ্ধ করতে গিয়ে অনেকে দিয়েছে নিজেদের প্রাণ, আবার অনেকে পঙ্গু অবস্থায় জীবন কাটিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের এই ঋণ কোনোদিনও শোধ করা যাবে না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্তরের সকল মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। তাই একে “গণযুদ্ধ” বা “জনযুদ্ধ” বলা হয়

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল মুক্তিযোদ্ধারাই ছিলেন আসল দেশপ্রেমিক। তারা ছিলেন অসীম সাহসী, দেশের বীর সন্তান ও আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ যোদ্ধা। নিজেদের জানের মায়া ত্যাগ করে তারা দেশকে স্বাধীন করেছিল। তাদের এই ত্যাগ জাতি চিরকাল স্মরণে রাখবে।

মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নেতৃত্বদানকারী দলটির নাম হলো আওয়ামী লীগ। মূলত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বই মুক্তিযুদ্ধের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করে। তারা ১৯৭০ সালে নির্বাচনে জয়লাভের মধ্য দিয়ে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে দেশের মানুষের মধ্যে স্বাধিকার চেতনার জাগরণ ঘটায়।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ ছাড়াও অনেকগুলো রাজনৈতিক দল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ ন্যাপ(ভাসানী), ন্যাপ(মোজাফফর) কমিউনিস্ট পার্টি, জাতীয় কংগ্রেসস ইত্যাদি।

আবার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কিছু দল পাকিস্তানিদের পক্ষে কাজ করে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ রাজাকার, আলবদর, আল-শামস ইত্যাদি। তারা হত্যা, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ সহ নানান ধরণের মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে জড়িত ছিল।

মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসমাজের ভূমিকা

মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসমাজের ভূমিকা

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে সেখানে ছাত্রদের ভূমিকাই ছিল সবচেয়ে বেশি। সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দিতে স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এটা শুধু স্বাধীনতা যুদ্ধ নয়।

পাকিস্তান আমলে ছাত্ররাই ছিল সকল আন্দোলনের প্রধান সংগঠক। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় তারা তাদের রক্তে রাজপথ রাঙিয়েছিল। এরপর ১৯৫৪, ১৯৬৬, ১৯৬৯, ১৯৭০ এর প্রতিটি আন্দোলনেই তারা রেখেছিল সক্রিয় ভূমিকা।

মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র জনতা ভ্যানগার্ড নামে অধিক পরিচিত ছিল। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে সারা দেশের ছাত্ররা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। অনেক শিক্ষার্থী তাদের অভিভাবকদের আড়াল করে রাতের অন্ধকারে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়।

তারা সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিবেশী ভারতে প্রবেশ করেছে।সেখানে যাওয়ার পর তারা সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে এবং গেরিলা হামলার মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনাদের জন্য পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তোলে।

মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা

মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামে নারীরাও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। অনেক নারীরাই প্রশিক্ষণ নিয়ে সরাসরি ঝাপিয়ে পড়েছিলেন নিজের জীবন বাজি রেখে। নারীরা কখনো যুদ্ধক্ষেত্রে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে আবার কখনো যুদ্ধেক্ষেত্রের আড়ালে।

তারা সবসময় মুক্তিযোদ্ধাদের মনে সাহস জুগিয়েছেন, প্রেরণা দিয়েছেন, অচেনা অজানা অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছেন। নিজেরা না খেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার রান্না করেছেন। অনাহারী, ক্ষুধার্ত মুক্তিযোদ্ধাদের তারা কখনো সেবা দিয়েছেন নিজের বোনের মতো, কখনো মায়ের মতো।

কখনো কখনো পাকিস্তানিদের হাত থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ষা করতে নিজেদের ঘরে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য নারীরা তেমন কোনো বিশেষ স্বীকৃতি পাননি। অনেক নারীযোদ্ধারাই হারিয়ে গেছেন।

মুক্তিযুদ্ধে গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকা

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা জোগাতে এবং জনগণের মনে আধার সঞ্চার করতে ও দেশে বিদেশে জনমত সৃষ্টিতে দেশ-বিদেশ থেকে প্রকাশিত হয় অসংখ্য নিয়মিত এবং অনিয়মিত পত্রিকা।

এসব পত্রিকায় তুলে ধরা হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাংলার বীরসেনাদের সাহসীকতার চিত্র এবং পাকবাহিনীর ধ্বংসলীলার দৃশ্য। পত্রিকাগুলোতে এ সম্পর্কে লেখা হতো বিভিন্ন প্রবন্ধ, ছড়া, রচনা, কবিতা, গল্প, গান, কার্টুন ইত্যাদি।

সেই সময়ে লেখা সেই পত্রিকাগুলো আজ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দলিল হিসেবে কাজ করছে। পত্রিকাসহ অন্যান্য গণমাধ্যমগুলোতেও বাঙালির বীরত্ব-সাহসিকতা, পাকিস্তানিদের হত্যাযজ্ঞ, গণহত্যা, বর্ণনা গুরুত্বের সাথে স্থান পেয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালিদের অবদান

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসে অবস্থানকারী বাঙালিরাও বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছেন। মূলত আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তারা সরবরাহকারী বাহিনীর ভূমিকায় কাজ করছেন। তারা বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য বিভিন্ন দেশের পার্লামেন্টে ছুটে গিয়েছেন। এছাড়াও তারা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার নিকট প্রতিনিধি প্রেরণ করেছে। পাকিস্তানকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ না করার জন্য বিভিন্ন প্রবাসী সরকারের নিকট আবেদন করেছেন। তাছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহের ক্ষেত্রেও তারা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধে শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল শক্তি ছিল জনগণ। কিন্তু দেশের শিল্পী-সাহিত্যিকরাও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে জড়িত ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধেও তাদের ভূমিকা প্রশংসনীয়।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দেশের শিল্পী-সাহিত্যিকরা পত্র-পত্রিকায় অবদান রেখেছিলেন, বেতারের খবর পড়তেন এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠান পরিবেশন করেন, বিভিন্ন ধরণের দেশাত্মবোধক গান ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গান, কবিতা, নাটক ইত্যাদি মুক্তিযুদ্ধের মতো কঠিন পরিস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বজায় রাখে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

মুক্তিযুদ্ধের সময় অত্যন্ত জনপ্রিয় চরমপত্র ও জল্লাধর দরবার অনুষ্ঠান দ্বারা মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাপক ভাবে অনুপ্রাণিত হন। সংক্ষেপে, দেশের সমগ্র বুদ্ধিজীবীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা মুক্তিযুদ্ধের আরও অগ্রগতি এবং শত্রু মোকাবেলা করার ভূমিকা রাখে।

মুক্তিযুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক বিশ্ব

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাকান্ডের চিত্র বিশ্বের সকল গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশ হতে থাকলে সকল রাষ্ট্র বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়িয়ে যায়। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত তখন প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়।

ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও বাংলাদেশের পক্ষে জনমত তৈরি করতে এগিয়ে আসেন। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ভারতের বাহিনীরাও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। যুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে সমর্থন দিলেও মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশের বিরোধিতা করে।

কিন্তু সেই দেশের সাধারণ জনগণের তোপের মুখে পড়ে মার্কিন রাষ্ট্র পাকিস্তানকে গোলাবারুদ সরবরাহ বন্ধ করতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য, আমেরিকান গায়ক জর্জ হ্যারিসন এবং ভারতীয় রবিশঙ্কর “বাংলাদেশের জন্য কনসার্ট” আয়োজন করেছিলেন এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করার জন্য বাংলাদেশকে অর্থ দান করেছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধে যৌথ বাহিনী

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে ২১ নভেম্বর ভারতের কমান্ডার জগজিৎ সিং অরোরার নেতৃত্বে গঠিত হয় বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডো। ভারতীয় সেই বাহিনী মিত্রবাহিনী নাম নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে পাকিস্তানের বিমানবাহিনীকে অচল করে দেয়।

ভারতীয় বিমানবাহিনী গভীর রাতে বাংলাদেশের সকল রুটে প্রবেশ করে এবং পাকিস্তানের প্রতিটি বিমানঘাটিতে হামলা চালায়। কুর্মিটোলা বিমানঘাটিতে ৫০ টন বোমা ফেলা হয়। তাদের আক্রমণে পাকিস্তানের প্রায় এক ডজনের মতো বিমান বিদ্ধস্ত হয়।

ভারতীয় বিমানবাহিনী ও বাংলাদেশের সশস্ত্র যোদ্ধাদের যৌথ আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা নাজেহাল হয়ে পড়ে। তখন শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত অধ্যায়। ভারতীয় যোদ্ধাদের সাথে এক হয়ে যুদ্ধ করে মুক্তিবাহিনীর মনোবল বাড়তে থাকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অনেক ভারতীয় সেনা মৃত্যুবরণ করেন।

মুক্তিযুদ্ধ ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড

মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে যখন মুক্তিবাহিনী ও যৌথবাহিনীর আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ছিল তখন পরাজয় নিশ্চিত জেনে তারা বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় ক্ষতি করার পদক্ষেপ নেয়। তারা তখন ঝাপিয়ে পড়ে আমাদের দেশের সূর্যসন্তানদের উপর।

আর এই কাজে তাদেরকে সাহায্য করেছিল এদেশের দোসর রাজাকার, আলবদর ও আল-শামস বাহিনী। তারা রাতের অন্ধকারে এদেশের মুক্তিকামী ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনকারী সকল শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে হত্যা করে। তাদের অনেকেরই ক্ষতবিক্ষত দেহ ঢাকার রায়ের বাজারের বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ

মাত্র নয় মাসের যুদ্ধেই পাকিস্তানের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে। পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যৌথবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমনে পাকিস্তানি বাহিনী নাজেহাল হয়ে পড়ে।

তার আর কোনো উপায় না পেয়ে হানাদার পাকবাহিনী ১৯৭১ সালের ১৬ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর কাছে নিঃশর্ত ভাবে আত্মসমর্পণ করে। ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ বিকাল ৫:০১ মিনিটে। লে. সোহরাওয়ার্দী উদয়ন ঢাকার রেস ট্র্যাকে জয়েন্ট কমান্ডোদের পক্ষে গুলি চালায়। জে. জাজিত সিং অরোরা এবং পাকিস্তানি লে. জে নিয়াজি পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাঙালিকে শোষণ-নিপীড়ন থেকে মুক্তি দিয়েছে। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, শতাব্দী প্রাচীন বাঙালি পরিচয়ের ওপর জোর দিয়েছে এবং ধর্মীয় কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে উঠে।

এই ঐক্য দেশ গঠনে এবং এর উন্নয়নে বাঙালিজাতিকে নতুন উদ্দীপনা প্রদান করে। দেশপ্রেম এবং জাতীয় সঙ্ঘতি একত্রে অত্যাবশ্যক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই পারে আমাদের সব বিভেদ ভুলে দেশপ্রেমিক বাঙালি হিসেবে লাল-সবুজ পতাকার তলে সমবেত করতে। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হওয়া আজ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

সমাজ-বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

বাংলাদেশের জনগণের স্বপ্ন ও আকাঙ্খার ভিত্তিতে স্বাধীনতা সংগ্রাম করা হলেও বাস্তবে সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। স্বাধীনতার পর বারবার সরকার পরিবর্তন, হত্যা ও রক্তপাতের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল এবং দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তৎপরতা দেখা দেয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য, যুবসমাজে দেখা দেয় হতাশা, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, ঘুষ, দুর্নীতি ইত্যাদি কারণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমাজে বাস্তবায়িত হতে দেয়নি।

সত্যিকার অর্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রয়োজন দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে আন্তরিক পদক্ষেপ।

এ লক্ষ্যে দুর্নীতিমুক্ত কল্যাণকর শাসনব্যবস্থা যেমন প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত গৌরবগাঁথা আর আত্মত্যাগের সঠিক ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা। যে আদর্শ, উদ্দেশ্য ও চেতনা নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ তাদের তাজা প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছে, ইজ্জত দিয়েছে হাজার হাজার মা-বোন, আমাদের সমাজ ও জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনাকে সঞ্চার করতে হবে- এটাই আমাদের অঙ্গীকার।

মুক্তিযুদ্ধ ও দায়িত্ববোধ

আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সফল করতে আমাদেরকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। তাই বর্তমানে এই স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষদের অধিকার ও সুরক্ষার বিষয়টা বাস্তবায়ন করতে আমাদেরকে কাজ করে যেতে হবে।

সকল নাগরিককে স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রতিক্রিয়াশীলরা যাতে দেশের ক্ষতি করতে না পারে তার জন্য নিবিড় পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন।

দেশের সকল দেশপ্রেমিক, ব্যবসায়ী, খন্ডকালীন শ্রমিক, শিল্পপতি, বুদ্ধিজীবী ও সকল শ্রমিককে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নে সচেষ্ট হতে হবে এবং সকল সংঘাতকে প্রাধান্য দিতে হবে। দেশকে একটি দারিদ্রমুক্ত, সুশিক্ষিত ও উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে সকল উন্নয়ন কার্যক্রমের বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে।

রচনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ।

রচনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে একটি সশস্ত্র যুদ্ধ যার ফলে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে আবির্ভূত হয়।

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালিদের হত্যার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে হানা দেয় এবং শুরু হয় গেরিলা যুদ্ধ ও গণমুক্তিযুদ্ধ।

এরপর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ এবং প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ। 1947 সালের আগস্টে, ভারতীয় উপমহাদেশ ব্রিটিশ শাসনের অধীনে স্বাধীনতা লাভ করে এবং ভারত দুটি স্বাধীন দেশে বিভক্ত হয়।

পাকিস্তান মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে গঠিত, যেখানে ভারত হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মের অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে গঠিত।

পাকিস্তানের নবগঠিত রাষ্ট্র দুটি প্রদেশ নিয়ে গঠিত, পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানে বাংলাদেশ) এবং পশ্চিম পাকিস্তান, 2,000 মাইল দ্বারা বিভক্ত।

ভৌগোলিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে যোজন যোজন দ্বারা বিচ্ছিন্ন, এই দুটি অঞ্চলে তাদের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসাবে শুধুমাত্র একটি ধর্ম ছিল।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে পশ্চিমের তুলনায় প্রাচ্য অনেক দিক থেকেই সুবিধাবঞ্চিত।

স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের আগে পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের 23 বছরের শোষণ ও দখলদারিত্বের দীর্ঘ ইতিহাস ছিল।

৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ :

১৯৭১ সালের মার্চের ৩ তারিখ পূর্ব ও পশ্চিম অংশের এই দুই নেতা পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতিকে সঙ্গে নিয়ে দেশের ভাগ্য নির্ধারণে ঢাকায় বৈঠকে মিলিত হন।

তবে এই বৈঠক ফলপ্রসূ হয়নি। বঙ্গবন্ধু পাঁচদিনের ধর্মঘট ও দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন।

হরতাল শেষে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ময়দান রেসকোর্সে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার ময়দান রেসকোর্সে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদয়ন) একটি ঐতিহাসিক ভাষণ দেন।

এই ভাষণে তিনি ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের আগেই বাস্তবায়নের জন্য চার দফা দাবি পেশ করেন-

১) অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে।

২) সামরিক বাহিনীকে সেনানিবাসে ফিরে যেতে হবে।

৩) নিহত ব্যক্তিদের সঠিক সংখ্যা অনুসন্ধান করতে হবে। তবে এই বৈঠক ফলপ্রসূ হয়নি। বঙ্গবন্ধু পাঁচদিনের ধর্মঘট ও দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন।

হরতাল শেষে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ময়দান রেসকোর্সে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার ময়দান রেসকোর্সে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদয়ন) একটি ঐতিহাসিক ভাষণ দেন।

অপারেশন সার্চলাইট ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামে একটি গণহত্যা চালায়।

এশিয়ান টাইমসের এক ভাষ্য অনুযায়ী, সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে ইয়াহিয়া খান এ কথা বলেন।

“তিরিশ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করো, তখন দেখবে বাকিরা আমাদের হাত চেটে খাবে।

সে পরিকল্পনা মতোই ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইট আরম্ভ করে যার উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দেওয়া।

এরই অংশ হিসাবে সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের নিরস্ত্র করে হত্যা করা হয়, ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের নিধন করা হয় এবং সারা বাংলাদেশে নির্বিচারে সাধারণ মানুষ হত্যা করা হয়।

স্বাধীনতার ঘোষণা:

মেহবুব রহমান জালাল, টেক্সাস-ভিত্তিক মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের দলিল সংগ্রহকারী, বলেছেন:

বিভিন্ন সূত্র এবং নথি থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, ২৬ মার্চের প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান,

যা ছিল তার বা অন্য কারো হয়ে ঘোষণা দেওয়ার অনেক আগে।

২৫ মার্চে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক ভেঙে গেলে ইয়াহিয়া গোপনে ইসলামাবাদে ফিরে যান।

এবং গণহত্যা চালানোর পর পাকিস্তানি সেনারা সেই রাতেই বঙ্গবন্ধুসহ তার পাঁচ বিশ্বস্ত সহকারীকে গ্রেপ্তার করে।

গ্রেপ্তার হওয়ার আগে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা লিখে যান।

মুক্তিযুদ্ধের সূচনা : 

২৫ মার্চের পরিকল্পিত গণহত্যার মুখে সারা দেশে শুরু হয়ে যায় প্রতিরোধযুদ্ধ।

পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট,

ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর),

ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ,

কয়েক মাসের মধ্যেই বাঙালী সৈন্যরা এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের মুক্তিকামী সাধারণ মানুষ দেশকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করতে মুক্তিবাহিনী প্রতিষ্ঠা করে।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে ভারতের ওপর নির্ভরশীল ছিল, সামরিক ও কূটনৈতিক সাহায্য লাভ করে।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ এবং বাঙালিদের বিজয়:

ডিসেম্বরের শুরুতে ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেয়।

মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনীর যৌথ আক্রমণের সম্মুখীন হয়ে ইতিমধ্যেই অভিভূত ও ক্লান্ত পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেয়।

১৬ ডিসেম্বর, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা রেসকোর্সে ৯৩,০০০ সৈন্যসহ আত্মসমর্পণ করে।

পূর্ব পাকিস্তানের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি 16 ডিসেম্বর,

1971 সালে ভারত ও বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় ফ্রন্টের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণের আদেশে স্বাক্ষর করেন।

এরই মাধ্যমে নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের অবসান ঘটে; প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙালি জাতির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ

বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা : 

বর্তমানে রাজনৈতিক দ্বিধা বিভক্ত ও আন্তর্জাতিক কুচক্রের প্রভাবে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাটি ঠুনকো হয়ে পড়েছে।

ব্যক্তি ও দল তার নিজ স্বার্থ রক্ষায় মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চক্রান্তের ফাঁদে ফেলছে জনগণকে।

ফলে জাতিয়তাবাদী চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধ সৃষ্টি হচ্ছে।

কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধকে দলীয় স্বার্থ সংরক্ষণে ব্যবহার করছে আবার কেউ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বদলে দেওয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।

ফলে বাঙালি জাতি দ্বিধাবিভক্ত। তাই তরুণ সমাজের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হবে।

উপসংহার

স্বাধীনতা যে মানুষের জন্মগত অধিকার, বাংলাদেশের মানুষ তা রক্ত দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছে। ত্রিশ লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছিলাম এই স্বাধীনতা। এর মাধ্যমে অবসান ঘটেছিল পাকিস্তানের প্রায় ২৪ বছরের শাসন, শোষণ ও নিপীড়নের।

তবে স্বাধীনতার ৪০ বছর পরেও আমরা এখনো বঙ্গবন্ধুর সেই সোনার বাংলা গড়তে পারিনি। স্বাধীন জাতি হয়েও স্বাধীনতার পূর্ণ স্বাদ এখনো আমরা পাইনি। তাই সকল সংকটকে দূরে ঠেলে আমাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের নিজেরদেরকে দেশপ্রেম, কর্তব্যবোধ, ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে পারলেই আমরা রক্ষা করতে পারব আমাদের স্বাধীনতাকে।

Share Article:

1 Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Best Bangla Article

Bangla Article

Best Bangla Article Website

banglaarticle.xyz ওয়েবসাইটে স্বাগতম।

এই ওয়েবসাইটে স্বাস্থ্য টিপস, বিউটি টিপস,বাংলা ক্যাপশন ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের বাংলা তথ্য শেয়ার করা হয়। বাংলা ভাষা ভালোবাসুন বাংলা আর্টিকেলর সাথে থাকুন।

Join the family!

Sign up for a Newsletter.

You have been successfully Subscribed! Ops! Something went wrong, please try again.
Edit Template

Trending Posts

-October 28, 2024
-October 27, 2024

Hot Posts

-October 26, 2024
-October 25, 2024

About

BanglaArticle.xyz হলো একটি তথ্যসমৃদ্ধ বাংলা কনটেন্টভিত্তিক ওয়েবসাইট, এখানে স্বাস্থ্য টিপস, বিউটি টিপস,বাংলা ক্যাপশন ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের মানসম্পন্ন বাংলা আর্টিকেল প্রকাশ করা হয়। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো পাঠকদের জন্য সহজ ভাষায় উপস্থাপিত জ্ঞানগর্ভ ও মানবিক উপযোগী কনটেন্ট প্রদান করা।

©2024 - 2025. Bangla Article. All Rights Reserved.