কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী-বিদ্রোহী কবির জীবন ও কর্ম।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রাণপুরুষ কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী আমাদের সংস্কৃতি ও সাহিত্যে একটি অমূল্য অধ্যায়। বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত নজরুল ছিলেন শুধু কবি নন, একইসঙ্গে তিনি ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ, নাট্যকার ও প্রগতিশীল চিন্তার পথিকৃৎ। কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী জানলে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন, সৃষ্টিকর্ম এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে অবদানের নানা দিক উদ্ভাসিত হয়। সাহিত্যজগতে তাঁর আগমন বাংলা কবিতায় এক নতুন ধারার সূচনা করে, যা আজও সমানভাবে সমাদৃত। কবির জীবন ও কর্ম থেকে প্রেরণা পেতে হলে কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী সম্পর্কে বিস্তারিত জানা জরুরি। তাঁর রচনা উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রেরণা জুগিয়েছে এবং মানবতাবাদী চেতনা ছড়িয়ে দিয়েছে।
শৈশব ও প্রাথমিক জীবন
কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ সালের ২৪ মে (১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কাজী ফকির আহমদ ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিন, এবং মা জাহেদা খাতুন ছিলেন এক গৃহিণী। ছোটবেলায় নজরুল “দুখু মিয়া” নামে পরিচিত ছিলেন, কারণ শৈশবেই তাঁর জীবন নানা দুঃখ-কষ্টে পূর্ণ ছিল।
মাত্র আট বছর বয়সে পিতার মৃত্যু হলে পরিবারে আর্থিক সঙ্কট নেমে আসে। নজরুল স্থানীয় মক্তবে পড়াশোনা শুরু করেন এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন, যেমন- মসজিদে মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন এবং লেটো গানের দলে অংশগ্রহণ। এখান থেকেই তাঁর সংগীত ও সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক বাড়তে থাকে।
শিক্ষা জীবন ও সামরিক ক্যারিয়ার
কাজী নজরুল স্কুলের পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি, কিন্তু বিভিন্ন সময়ে স্কুলে ও মক্তবে পড়াশোনার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করেন। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে করাচিতে অবস্থান করেন। এই সময়েই তাঁর মধ্যে সাহিত্যচর্চা জোরদার হয়। করাচি ক্যান্টনমেন্টে থাকাকালে নজরুল নিয়মিত বইপত্র পড়তেন, যা তাঁর মানসিক বিকাশে বিশেষ অবদান রাখে।
সাহিত্যিক জীবন ও বিদ্রোহী কবি পরিচিতি
১৯২২ সালে প্রকাশিত বিদ্রোহী কবিতার মাধ্যমে নজরুল বাংলা সাহিত্যে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। এই কবিতা ছিল শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং স্বাধীনতার পক্ষে এক জোরালো আওয়াজ। তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ লেখালেখি শুরু করেন এবং একই বছরে ধূমকেতু নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন, যা ব্রিটিশদের রোষের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
নজরুলের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে –
- অগ্নিবীণা (১৯২২)
- বিষের বাঁশি (১৯২৪)
- ভানুসিংহের পদাবলী (১৯২৭)
তাঁর রচনায় বিদ্রোহের পাশাপাশি প্রেম, প্রকৃতি এবং মানবতার বিষয়গুলোও উঠে এসেছে।
সঙ্গীতে অবদান
কাজী নজরুল ইসলাম একাধারে বাংলা সংগীতের এক নতুন ধারার প্রবর্তক। তাঁর লেখা ও সুর করা গানগুলো নজরুলগীতি নামে পরিচিত। নজরুলগীতিতে প্রেম, ভক্তি, এবং মানবিকতার পাশাপাশি বেদনারও প্রকাশ ঘটে। হিন্দু-মুসলিম ঐক্যকে সামনে রেখে তিনি বহু ভক্তিগীতিও রচনা করেন।
কীভাবে নজরুল সংগীত আলাদা:
- তিনি পশ্চিমা সংগীতের সাথে ভারতীয় রাগসংগীতের মিশ্রণ ঘটান।
- হিন্দু দেবদেবী ও ইসলামি সংস্কৃতির সমন্বয়ে গান রচনা করে সম্প্রীতির বার্তা দেন।
- তাঁর গানগুলোতে বিপ্লব ও স্বাধীনতার তাগিদ ফুটে ওঠে।
ব্যক্তিজীবন ও অসুস্থতা
১৯২৪ সালে নজরুল প্রমীলা দেবীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের দুই পুত্রসন্তান ছিল, যদিও পরবর্তী সময়ে পরিবারের অনেকেই নানা রোগে ভুগে মারা যান। ১৯৪২ সালে নজরুল পিক্স ডিজিজ নামে এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন, যার ফলে তাঁর সৃজনশীল জীবনের অকাল সমাপ্তি ঘটে। বাকশক্তি হারানোর পাশাপাশি তিনি মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন।
বাংলাদেশের জাতীয় কবি
১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার নজরুলকে সপরিবারে ঢাকায় নিয়ে আসেন এবং তাঁকে জাতীয় কবি হিসেবে সম্মাননা প্রদান করেন। তাঁর অসাধারণ সৃষ্টিশীলতা এবং বিপ্লবী চেতনা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণা জুগিয়েছিল। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকা শহরের পিজি হাসপাতালে কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
কাজী নজরুলের সাহিত্যকীর্তির প্রভাব
নজরুলের সাহিত্য বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে এবং তাঁর রচনায় শোষণ, সাম্প্রদায়িকতা এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিবাদ ছিল স্পষ্ট। বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হলেও তাঁর রচনায় প্রেম এবং মানবতার মূর্ত রূপ ফুটে উঠেছে।
কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে ২০টি গুরুত্বপূর্ণ বাক্য:
কাজী নজরুল ইসলাম ২৪ মে ১৮৯৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি বাংলা সাহিত্য ও সংগীত জগতে “বিদ্রোহী কবি” হিসেবে পরিচিত।
নজরুল ইসলাম প্রথম জীবনে মক্তবে আরবি, ফারসি ও ইসলামী ধর্মশিক্ষা গ্রহণ করেন।
শৈশবে বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যেমন মক্তবের শিক্ষক ও লেটো গানের দলে অংশগ্রহণ।
১৯১৭ সালে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে করাচিতে দায়িত্ব পালন করেন।
নজরুলের সাহিত্যিক জীবন শুরু হয় পত্রিকায় কবিতা ও গল্প প্রকাশের মাধ্যমে।
১৯২২ সালে প্রকাশিত বিদ্রোহী কবিতা তাকে রাতারাতি জনপ্রিয় করে তোলে।
তার সাহিত্য ও সংগীত ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে উৎসাহ যোগায়।
নজরুল শুধু কবিতাতেই নয়, সংগীত রচনাতেও দক্ষ ছিলেন এবং প্রায় ৪,০০০ গান রচনা করেন, যা “নজরুলগীতি” নামে পরিচিত।
তিনি প্রথম মুসলিম কবি যিনি বাংলা সাহিত্যে প্রেম, বিদ্রোহ ও মানবতার মিশ্রণ ঘটান।
১৯২৪ সালে প্রমীলা দেবীর সঙ্গে তার বিবাহ হয়, যা আন্তঃধর্মীয় সম্পর্কের উদাহরণ হিসেবে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
নজরুলের উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হলো ব্যথার দান এবং মৃত্যুখেলা।
১৯৩০ সালে ব্রিটিশ সরকার তাকে তার সাহিত্যকর্মের জন্য কারাগারে পাঠায়।
জেলখানায় থাকা অবস্থায় তিনি রাজবন্দীর জবানবন্দি রচনা করেন।
নজরুল ইসলাম মানবতা, সাম্যবাদ, এবং ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে সোচ্চার ছিলেন।
তার রচনায় হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রতিফলন দেখা যায়।
১৯৪২ সালে তিনি পিক্স ডিজিজে আক্রান্ত হন, যার ফলে বাকশক্তি এবং সৃজনশীলতা হারিয়ে ফেলেন।
বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালে তাকে ঢাকায় এনে জাতীয় কবি হিসেবে সম্মাননা দেয়।
২৯ আগস্ট ১৯৭৬ সালে নজরুল ইসলাম ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।
এই ২০টি বাক্য কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও কর্মের সারমর্ম তুলে ধরে।
কাজী নজরুল ইসলাম কয়টি বিয়ে করেন?
কাজী নজরুল ইসলাম মোট দুটি বিয়ে করেছিলেন। তার জীবনের এই বিবাহগুলোকে ঘিরে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা রয়েছে।
১. প্রথম বিয়ে: নারগিস আসগর (১৯২১)
- নজরুলের প্রথম বিয়ে হয় কলকাতার একটি প্রভাবশালী মুসলিম পরিবারে। কুমিল্লার নবাব পরিবারের মেয়ে নারগিস আসগর (প্রথম নাম “প্রমীলা” ছিল) ছিলেন তার প্রথম স্ত্রী। তবে এই বিয়ে বেশি দিন টেকেনি। সাংস্কৃতিক পার্থক্য এবং পারিবারিক জটিলতার কারণে খুব শীঘ্রই সম্পর্ক ভেঙে যায়।
২. দ্বিতীয় বিয়ে: প্রমীলা দেবী (১৯২4)
- নজরুলের সবচেয়ে পরিচিত এবং দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক ছিল প্রমীলা দেবীর সঙ্গে। প্রমীলা ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী, এবং তাদের এই আন্তঃধর্মীয় বিয়ে তৎকালীন সমাজে চমক সৃষ্টি করেছিল।
- এই বিয়েতে নজরুলের পরিবারের সম্মতি না থাকলেও, তাদের ভালোবাসা এতটাই গভীর ছিল যে তারা সমস্ত বাধা পেরিয়ে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
- প্রমীলা এবং নজরুলের একসঙ্গে চার সন্তান জন্মগ্রহণ করেন।
সংক্ষেপে, নজরুল ইসলাম দুবার বিয়ে করেছিলেন। তার প্রথম বিয়ে ব্যর্থ হলেও, দ্বিতীয় বিয়ে প্রমীলা দেবীর সঙ্গে টিকে থাকে জীবনের শেষ পর্যন্ত।
কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ও মৃত্যু তারিখ
কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ও মৃত্যু তারিখ:
- জন্ম: ২৪ মে ১৮৯৯ (১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬ বঙ্গাব্দ)
স্থান: চুরুলিয়া গ্রাম, আসানসোল, পশ্চিমবঙ্গ, ব্রিটিশ ভারত। - মৃত্যু: ২৯ আগস্ট ১৯৭৬ (১২ ভাদ্র, ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ)
স্থান: ঢাকা, বাংলাদেশ।
তিনি জীবনের শেষ সময়টুকু দীর্ঘ রোগভোগের মধ্যে কাটান। মৃত্যুর পর তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়।
কাজী নজরুল ইসলামকে বিদ্রোহী কবি উপাধি দেন কে?
কাজী নজরুল ইসলামকে বিদ্রোহী কবি উপাধি দেন মুসলিম সাহিত্য সমাজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন।
এই উপাধি নজরুলের প্রথম কবিতা সংকলন বিদ্রোহী (১৯২২) কবিতার জন্যই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কবিতাটি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও স্বাধীনতার চেতনা জাগিয়ে তোলে, যা তাকে এই বিশেষ খেতাবে ভূষিত করে।
উপসংহার
কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ছিল সংগ্রাম ও সৃষ্টির মিলিত রূপ। তাঁর সাহিত্য এবং সংগীত মানুষের মুক্তি ও মানবতার জয়গানে ভরপুর।বিদ্রোহী কবি হিসেবে তিনি যুগে যুগে মানুষের মনের ভিতর স্বাধীনতার আগুন জ্বালিয়ে যাবেন।
আজও তাঁর রচনা আমাদের অনুপ্রাণিত করে, এবং আগামী দিনেও তাঁর সাহিত্য নতুন প্রজন্মকে আলোকিত করবে।